জীবন

 ধড়মড়িয়ে ঘুম থেকে উঠেই ঘড়িটার দিকে তাকালো রাব্বি,সকাল ৮.১৫ বাজে,দ্বিতীয় কিছু চিন্তা করার আগে গোসল করতে গেল কারণ আজকে পবিত্র ঈদ উল ফিতর,৮.৩০ এ নামাজের ঘোষনা হয়েছিল গতকাল,কোনোভাবে গোসলটা শেষ করলো,বাংলা সাহিত্যের  নক্ষত্র হুমায়ুন আহমেদ স্যার বলেছিলেন গোসল দুই প্রকারের হয় একটা হচ্ছে প্রকৃত গোসল,আরেকটা "গা-ধোয়া" মনে মনে ভাবলো তার টা মেইবি গা ধোয়ার কাতারেই পড়েছে।

 নতুন পাঞ্জাবি টা পড়ে আয়নার সামনে দাড়ালো অনেক খানি শুকিয়ে গেছে সে,তাতে অবশ্য মনে মনে খুশিই রাব্বি।কিন্তু এই শুকিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে আরোও অনেক কিছুই শুকিয়ে গেছে তার।প্রফুল্ল জীবনবোধ,আকাঙ্ক্ষা,স্বতস্ফুর্ততা,বুকের ভেতরের আগের সেই উত্তাল নদীটাও শুকিয়ে গেছে।


নামাযের আগে হুজুর বলছেন "এই দুনিয়ার মোহ ত্যাগ না করতে পারলে আখিরাতে তার জন্য কোনো সুখবর নাই"

রাব্বি ভাবে সৃষ্টিকর্তা মনে হয় তাকে এক্ষেত্রে অনেক বড় নেয়ামত দিয়ে দিয়েছেন,কারন তার এ দুনিয়ায় মোহাচ্ছন্ন হওয়ার মতোই কিছু নেই।


নামাযের শেষে মহেশখালী দ্বীপের এক ছোট্ট ঘরে সে শুয়ে আছে,মা কাদছেন প্রায় ৫০০ কিলো দূর থেকে,বোনটাও মায়ের কাছে নেই,একটা বেসরকারি  মেডিকেল এ পড়াশোনা করে, ঢাকায় থাকে,মা একা।বাবা আছেন শুধু স্মৃতিতে,চোখের কোণে পানির অস্তিত্ব টের পায় রাব্বি।সবাইকে ছেড়ে একা পড়ে আছে অজানা এক দ্বীপে,কিসের মায়ায়,কিছুক্ষণ আগেই না চিন্তা করলো ওর কোনো মোহ নেই,এটা কি মোহ?জীবিকাও কি মোহ?কত কিছু ত্যাগ করে এসেছে ছোট বোনটা আর মায়ের মুখে হাসি দেখবে বলে!সে হাসিই তো দেখা হচ্ছে না,তাও তাকে শুনতে হচ্ছে "টাকা পয়সার জন্য আজকে ঈদের দিনও মায়ের কাছে পুলাডা নাই,টাকা মানুষরে জানোয়ার বানায়া ছাড়ে"

তার ছেড়ে আসা এলাকার এক ইমাম সাহেবের এমন মন্তব্য শুনে নিজের অস্তিত্বের মূল্য খুজে পায় না রাব্বী।


চোখ মুছে রাতে রান্না করা মুরগীর মাংসের তরকারি টা চেখে দেখলো,মশলাপাতি কম হয়েছে হয়তো,ঝোলটা পানসে পানসে লাগছে।নাকি তার জিহ্বা স্বাদ বুঝতে পারছে না,সব কিছুই পানসে লাগছে,তরকারি, জীবন,অর্থ,সুখ,দুঃখ সব কিছুই পানসে কোনোটারই প্রকৃত স্বাদ পাচ্ছে না সে।


দুপুরে খাওয়ার পর পরিকল্পনাবিহীন ভাবে সমুদ্র পাড়ে আসে,দুপুরের রোদ আরোও তীব্র হওয়ার কথা বেশ মৃদু লাগছে তার কাছে,অনেকটা শীতের সকালের রোদের মতো,গতকাল রাতে ভারী বর্ষন হয়েছে এটাও কারন হতে পারে,হঠাৎ সমুদ্রস্নানের খেয়াল চাপলো তার,মোবাইল,ক্যামেরা আনেনি সুবিধেই হয়েছে,পুরো সৈকতে সে ছাড়া আর কোনো প্রানী চোখে পড়ছে না,এদিক টাতে এমনিতেই মানুষ কম আসে,এখান রিসোর্ট নেই,ছোট ছোট ঢেউ যেখানে এসে মিলিয়ে যাচ্ছে সেখানে বসে পড়লো রাব্বি,পানির ঝাপটা তার উত্তাল হৃদয়ে কিছুটা হলেও প্রশান্তি আনে,সমুদ্রে ঢেউয়ের তালে গেয়ে যাওয়া সামুদ্রিক গান গাইছে সমুদ্র,আদিম কোনো অদ্ভুত সুরের মতো লাগছে,পানি যত ঢেউ বড় হচ্ছে পুরোনো স্মৃতি গুলোও তত বেশি মনে পড়ছে।কত রঙের মানুষ তাকে ব্যাবহার করেছে জীবনে,কেউ টিস্যুর মতো কেউ ঠোঙার মতো,এক চিলতে সরল হাসিতে সকল দুঃখ লুকিয়ে ফেলে ঠিকই সমাজের কাছে চিরসুখী হয়ে ওঠে সে,নিজের সরলতার প্রতি নিজেরই বিরক্তি চলে আসে মাঝে মাঝে,সংশয় ও ভয় মেশানো কোনো অজানা আতঙ্ক কাজ করে সবসময়।


আরেকটু এগিয়ে বসতে ইচ্ছে করে রাব্বির,এগিয়ে যায়,আরেকটু এগোলে ঢেউয়ের তাল সামলানো কঠিন হবে।কিন্তু তার মন তার চিন্তাশক্তির বিপরীতে কাজ করছে,মনে হচ্ছে যেন সমুদ্রের একেবারে তলদেশে চলে যাই,মাটির উপরের প্রানী গুলোর প্রতি তার তীব্র ঘৃণা জন্মে গেছে।


সমুদ্রের পানিতে মাথা ভিজিয়ে দ্রুত উঠে পড়লো রাব্বি,বাসায় এসে দেখে গায়ের তাপমাত্রা বেড়ে গেছে,থার্মোমিটার নেই,জ্বর হলেও মাপা যাবে না,কাপড় চেঞ্জ করে কাথা গায়ে শুয়ে পড়লো রাব্বি,জ্বর আসলে মাথা ভারী ভারী মনে হয় তার,এত ওয়েভ ও মাথায় আসে না,চিন্তা শক্তি একমূখী হয়,কম হয়।

তার সারাজীবন যদি জ্বর-ই থেকে যেতো!

Previous Post Next Post