বাড়ির নাম সুন্দর মহল। তারিখ পহেলা এপ্রিল,উনিশশো ছিয়ানব্বই সাল। ফজরের ওয়াক্ত হচ্ছে এমতাবস্থায় সুন্দর মহলের সকল সদস্যদের মুখে এক উচ্ছ্বাস মাখা আনন্দের ছাপ। কারণ, শহীদ সাহেবের বড় ছেলের ঘরে প্রথম ছেলে সন্তান জন্ম নিয়েছে ! শহীদ সাহেবের বড় ছেলের নাম মো. আসগোর আলী খান। আসগোর আলী খুব কর্মঠ ব্যক্তি। সন্তান জন্ম নেওয়ার আগেই সন্তানের সকল বিধি -নিষেধ সে তালিকা করে রেখেছেন। আসগোর আলী বললেন, " আমার ছেলের নাম হবে নাদিফ আল হুসাইন খান।" নামটি তে সকলে একমত পোষণ করলেন এবং মুসলিম রীতি অনুযায়ী আল্লাহ তা'লার প্রতি শুকরিয়া আদায় করার জন্য পবিত্র আকিকার আয়োজন করা হলো। সকল পাড়া-প্রতিবেশী,আত্মীয়-স্বজন সকলে আসলেন দাওয়াত পেয়ে। আমারও সৌভাগ্য হয়েছিলো সে পবিত্র আয়োজনে অংশ গ্রহণের। তারপর বছর কয়েক যাবার পর যখন নাদিফ গুটি গুটি পায়ে হাঁটতে শুরু করলো এবং কথা বলতে শিখলো তখন তার মুখের প্রথম শব্দটা ছিলো আল্লাহ! আমার মনে হয় নাদিফ কে মহান রাব্বুল আল-আমীন খুব মহব্বত করেন তাই শিশুটির মুখের প্রথম নামটি ছিলো মহান সৃষ্টিকর্তা এক আল্লাহ। আসগোর আলী ছিলেন একজন সরকারি প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা। বদলিকৃত কারণে উনি পরিবারকে নিয়ে শিক্ষা নগর ময়মনসিংহ শহরে চলে আসেন। আসগোর আলীর পরিবারের সকলেই উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন তাই তার ইচ্ছে আপন সন্তান কেউ সে সেরকম ভাবেই আবিষ্কার করবেন। কিন্তু সব কিছু তো আর আপন মরজি অনুযায়ী হয় না ! নিয়তি বলে বিশেষ বিষয় আছে, যা সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত। নাদিফ শৈশবকাল থেকেই খুব খেলা পাগল একটি ছেলে।পড়াশোনার মাঝে একটু সময় পেলেই সে তা খেলার পেছনে ব্যয় করতে ভালোবাসে। তার প্রবল ইচ্ছে সে ওয়াসিম আকরামের মতো একজন দূরন্ত পেস বোলার হবেন। নাদিফের এই খেলাধুলা করার বিষয়টি যখন মিসেস. আসগোর নাদিফের বাবাকে জানালেন তখন যে সিদ্ধান্ত টি পরিবারের পক্ষ থেকে নেওয়া হয় সেটি নাদিফের জন্য আশানুযায়ী ছিলো না। নাদিফকে এসব থেকে ছড়িয়ে আনতে তাকে গৃহবন্দি করে রাখার সিদ্ধান্ত নেয় তার পরিবার। তার বাবার একটি কথা পড়াশোনা করে মস্ত বড় কর্মকর্তা না হলে নাকি এই পৃথিবীর কাছে কোনো মূল্য নেই মানুষের! আসলেই কি তাই? মানুষ কি শুধু আপন সম্পদ আর শিক্ষা সার্টিফিকেট অর্জনের জন্যই এই ধরায় এসেছে নাকি মনুষ্যত্ব দিয়ে জীবসত্ত্বা কে পরাজিত করতে এসেছে? আসগোর আলী যখন কোনো ভাবে পারছিলেন না ছেলেকে বাঁধা দিতে তখন মাধ্যমিকে তার ছেলেকে তার নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী বিজ্ঞান বিভাগে পড়ানোর ব্যবস্থা করে আসলেন। নাদিফ তখন খুব ভেঙে পড়লো,সে ভাবতে লাগলো তার তো বৈজ্ঞানিক ভাবনা বা বিদ্যা ভালো লাগে না। সে সবসময় বাস্তব নির্ভর ইতিবাচক কিছু আবিষ্কারের কল্পনা করেন। এখন বিজ্ঞান পড়লে সেটা কি করে সম্ভব? বছরের পহেলা দিন থেকেই নাদিফের বাসায় গৃহশিক্ষকদের আসা-যাওয়া আরম্ভ হলো। সকল গৃহশিক্ষকদের একটায় বক্তব্য,‘নাদিফ তোমাকে ক্লাসে প্রথম হতে হলে আর ভালো কর্মজীবনে যেতে আমার নোটের বিকল্প নেই;এগুলো সারাদিন বসে মুখস্থ করলেই স্টার মার্কস সুনিশ্চিত।' আমরা কি সত্যি নিজ সন্তানদের ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে ভাবি নাকি সমাজের এই অন্ধকার চিন্তার চাপটা তাদের উপর চাপিয়ে দিয়ে বুঝাতে চায় জীবন বড়ই সুন্দর বাবা, কোনটা? অধিকাংশ পিতা-মাতা মনে করেন সন্তান আমার মস্ত বড় হবে যদি সে শিক্ষকের দেওয়া নোট জীর্ণ করে ছেড়ে দিয়ে আসে পরীক্ষার খাতায়। নাদিফ এর মনের কথা বুঝার মতো তখন স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কেউ ছিলেন না! হঠাৎ ই অদ্ভুত এক মহা মানবের আগমন নাদিফদের জীবনে। তার নাম হচ্ছে জায়েদ সরকার। জায়েদ সরকার একজন শিক্ষা গুরু। সকলে তাকে গুরুজি বলে ডাকেন।কারণ তিনি তার শিষ্যদের যা শিক্ষাদেন তা অন্তর চক্ষু খুলে দেয়। নাদিফ তার বন্ধু লতিফের কাছে গুরজির বিষয়ে জানতে পারে।
প্রথম দিন-
এবং তৎক্ষণাৎ উনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তখন গুরুজি জানতে চান নাদিফের কাছে তার সমস্যার কথা? নাদিফ তখন স্বতস্ফূর্তভাবে বলেন গুরুজি সালাম নিবেন! আমি যে দীর্ঘ সময় ধরে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছাতে চাচ্ছি, কিন্তু পারিবারিক বাঁধার জন্য পাচ্ছি না। এর সঠিক সমাধান কি হতে পারে আপনি বলেদিন গুরুজি! তখন গুরুজি উত্তর দেয় তোমার ভেতরের নফসের চিকিৎসা প্রয়োজন। র চক্ষু যেদিন দেখতে শেখবে তখন মহান স্রষ্টায় তোমার সঠিক পথ ও গন্তব্য জানিয়ে দিবেন নাদিফ। নাদিফ তখন চিন্তিত হয়ে পড়লো, গুরুজি আমাকে এসব কি বলেন?কিসের আবার অন্তর চক্ষু, কিসের নফস? সেদিন আর আলোচনা দীর্ঘ না করে গুরুজি কে নজরানা দিয়ে দরবার ত্যাগ করেন নাদিফ। নাদিফ তার বাসায় এসেও নিবিড় ভাবনায় মননিবেশ করতে শুরু করলো। হঠাৎ ভাবতে ভাবতে কে যেনো নাদিফ কে বলছেন,“তুমি তোমার মনকে নিয়ন্ত্রণ করা শেখে যাও,বাকিটা এমনিতেই হয়ে যাবে। ”
দ্বিতীয় দিন-
নাদিফ গুরুজির দরবারে উত্তর নিয়ে হাজির। দরবারের প্রবেশিকার সামনে দাঁড়িয়ে বললো,“সালাম গুরুজি, আমি কি আসতে পারি?” তখন গুরুজি বললেন,“ভেতরে আসো নাদিফ।” নাদিফ প্রবেশ করেই কদমবুসি করলেন এবং দোয়া নিলেন। তারপর গুরুজিকে সে বললো,“গুরুজি আমি গতকাল আপনার কথার একটা ব্যাখ্যা খুঁজে পেয়েছি। কে যেনো অলৌকিক ভাবে বলে উঠলেন আমাকে, আমি যেনো আমার মনকে নিয়ন্ত্রণ করা শেখে যাই,তবেই সকল সমাধান চলে আসবে! আমি কি তবে গুরুজি ভুল কোনো পথে পা দিয়েছি? ” গুরুজি তখন বললেন,“না তুমি ভুল পথে পা দাও নি, তবে তোমার দ্বারা মহান রাব্বুল আলামীন তো অন্য কিছু হাসিল করাতে চায় রে ব্যাটা। ব্যাটা,তুমি কি বুঝতে পারছো? তোমার কি স্মরণ হয় তোমার শৈশবকালের সেদিনের কথা যেদিন তুমি ‘আল্লাহ’ বলে প্রথম তোমার কথা বলার যাত্রা শুরু করেছিলে?” নাদিফ তারপর গুরুজির শিষ্যত্ব গ্রহণ করলো এবং জীবনের মানে কি তা নতুন করে উপলব্ধি শেখলো!
©গল্পের সকল স্বত্ব গল্পের লেখক মোঃ লতিফুর রহমান খান কর্তৃক সংরক্ষিত ও সুরক্ষিত