অন্তর্দাহ

লেখক এম. আর. সুমন

অন্তর্দাহ

এম. আর. সুমন


শিশির মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। যার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়াই ছিল দুঃস্বপ্ন। মেধায় আর নিজের পরিশ্রমে অসাধ্যকে সাধন করে আজ সে চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। ক্লাস, টিউশন আর অসহায় মানুষের জন্য কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এ নিয়েই তার জীবনের গণ্ডি।


আজ শিশিরের বিকাল ৫ টায় টিউশন ছিল। কিন্তু, তার ক্লাস শেষ হতে না হতেই ৪:৪৫ বেজে গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসটাও আজ সময় মত আসছে না। ছাত্রের বাসায় পৌঁছানো তো দূরের কথা বাসে চড়তেই ঘড়ির কাটায় ৫ টা ১০ বেজে গেল। বড্ড ক্লান্তি লাগছিলো শিশিরের। সারাদিন ক্লাস, পড়াশোনা, বিকেলের প্র‍্যাক্টিক্যাল মাথা ধরিয়ে দেয়। শিশির বাসের সিটে হেলান দিয়ে চোখটা বন্ধ করেছিল কখন খেয়াল নেই। ব্রিজের মোড়ে জ্যামের মধ্যে বাস আটকে আছে। বাসের হেলপারের চিল্লানোতে ঘুম ভাঙে শিশিরের। বাস থেকে নেমে বাকি পথ টুকু দ্রুত পায়ে হেঁটেই আসলো সে।


৫:৩৫। ছাত্রের বাসায় কলিং দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো, দরজা খুলতে দেরি হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর দরজা খুললো ছাত্রের আম্মু।

-শিশির, এতো দেরি কেন? পরশের ৭ টায় আরেকজন শিক্ষক আসেন। 

তোমার পড়ানো শেষ হলে একটু রেস্ট নিতে হয়, আজকে আর কী পড়াবা?

একটানা অনড়গল এত্তোগুলা কথা শুনিয়ে দিলো। শিশিরের ‘আচ্ছা, আন্টি’’ বলা ছাড়া উপায়ন্তর ছিলো না।

-শুক্রবার দিন এসে পড়িয়ে দিবনে তাহলে আন্টি?

শিশির পড়ায় সপ্তাহে তিন দিন। একদিন পর পর। শুক্র, শনি পাশাপাশি দুদিন বন্ধ থাকে। এই বন্ধের দিন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গুলোর প্রোগ্রাম থাকে। প্রতি শুক্রবারই কোনো না কোনোটার প্রোগ্রাম থাকে। এ শুক্রবারও একটা প্রোগ্রাম রাখা আছে। আন্টির এতো কথা শুনার পর শুক্রবারের কথা বলা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। অবশ্য এরকম ঘটনা প্রায়শই ঘটে। পড়াতে গিয়ে দেখা যায় কোন ছাত্র না বলেই বন্ধুদের কোনো প্রোগ্রামে গেছে, কেউ আবার যাওয়ার পর বলে, ‘স্যার, আজকে পড়তে ইচ্ছে করছে না, মাথা ব্যথা।’’ শুক্রবার দিনটা ব্যাক আপের জন্যেই রাখা। প্রোগ্রাম শেষে টিউশন অথবা টিউশন শেষ করে প্রোগ্রাম। জীবনের এ ছুটে চলার সমাপ্তি যে কবে হবে! দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ছেড়ে পরের টিউশনের উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করলো শিশির।


শুক্রবার সকাল সকাল ঘুম ভাঙলো শিশিরের। প্র‍্যাক্টিক্যাল খাতা জমা দেওয়ার শেষ দিন রবিবার। একটানা দুপুর ১২ টা পর্যন্ত খাতা লিখলো সে। সকালের নাস্তা আর করা হলো না। এমনটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া হলে থাকা অধিকাংশ ছাত্রই ঘটে। সকালের নাস্তা হয় দুপুরে! নামাজ পড়ে ভিড়াভিড়ির মধ্যে ঠ্যালাঠেলি করে হোটেল গুলোতে খেতে হয় শুক্রবার দিন। সবাই নামাজ শেষ করে একসাথে আসে আর তাই এমনটা ঘটে। কেউ কেউ ব্যতিক্রম আছেন। খাবারের এই ঝামেলা এড়ানোর জন্যে নামাজের যাওয়ার সময় আগে খাবার সেরে যান তারা।  বিশেষ করে তাবলীগ করে যে সকল ছাত্ররা। তাবলীগের ছেলেদের নিয়মানুবর্তিতা চমৎকার। ফজরের নামাজ পড়ে পড়াশোনা, তারপর ডাইনিংয়ে সবাই মিলে এক সাথে নাস্তা করে। দুপুরে নামাজ আদায় করে খেয়েদেয়ে ঘুম, তারপর কিছুক্ষণ পড়াশোনা, আসরের আযান হলে টেবিল ছেড়ে নামাজের জন্য প্রস্তুতি, বিকেলের গাস্ত (অন্যকে নামাজের জন্য দাওয়াত দেওয়া), চমৎকার এক সিডিউল মেনে চলে তারা। এদের অনেকেই খুব সফলকাম হয় জীবনে, হয় সকলের পছন্দনীয়। আবার কেউ কেউ ধর্মকে কঠিন করে তুলে, হয়ে ওঠে অত্যধিক গোঁড়া। মসজিদ, নামাজ ছাড়াও মানুষের জীবনের আরও যে অনেক ব্যাপার থাকে এগুলো কিচ্ছু বোঝে না, বুঝতে চায় না। 


শিশির নামাজ শেষ করে হোটেলে আসলো। এতো ভীড়! সিট পাওয়া সম্ভব না। একটা পার্সেল নিয়ে হলে চলে আসলো। মাথায় ঘুরছে বিকেলের প্রোগ্রামের কথা। বিকেল ৫ টায় প্রোগ্রাম সঞ্চালনরা দায়িত্বে সে।


৩:৩০। দ্রুত বের হয়ে গেলো পরশকে পড়ানোর উদ্দেশ্যে। প্রচণ্ড রোদ। আজকে বাস চলাচল বন্ধ। অটোরিকশা (ইজি বাইক) নিয়ে ব্রিজের মোড়, তারপর আবার হাঁটা। মাথাটা ধরে গেছে। অঙ্ক করাতে একদমই ভালো লাগছেনা তার। শিশির ছাত্রকে আগের কিছু অঙ্ক করতে দিয়ে, সোফায় কাত হয়ে মেসেঞ্জারটা অন করতেই- রিনির মেসেজ! বিশাল বড় একটা মেসেজ দিয়ে রেখেছে রিনি। এই রিনিই হচ্ছে শিশিরের প্রথম এবং একমাত্র প্রেম (তবে শেষ প্রেম হবে কী না তার নিশ্চয়তা নেই!)। হ্যাঁ, কথাটা একমাত্রই লিখেছি। আজকালকের ছেলে-মেয়েদের একাধিক গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ড থাকে কি না! গভীর প্রেম, একজন আরেকজনকে ছাড়া বাঁচে না তবু দেখা যায় ভেঙে গেছে সম্পর্ক। ভালো পাত্র পেয়ে বাবা-মার পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করে ফেলে। ছেলের জীবন কাটে রাস্তায় রাস্তায় চাকরির পিছনে দৌড়ে, অফিস টু অফিস জুতার তলা ক্ষয়ে যায়, এক সময় সোনার হরিণের দেখা মিলে ততোদিনে প্রিয়তমা আরেকজনের সাথে যৌবনরস উজ্জীবিত করে হয়ে ওঠে দুই সন্তানের মা।


শিশিরের জীবনে কী ঘটবে তা হলফ করে বলা সম্ভব নয়। রিনি বড়লোকের আদুরের দুলালি। টিউশনেই হয়েছিলো তাদের পরিচয়। ভালোলাগা থেকেই ভালোবাসা, কিন্তু, ভালোবাসা থেকে প্রণয় নাও হতে পারে। জীবন রহস্যময়, রহস্যেঘেরা। রহস্যের মধ্যেই আমরা ডুবে সাঁতরে বেড়াই। যাকগে সে কথা।


রিনি লিখেছে, ‘তোমাকে নিয়ে আজকে অনেক সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখেছি। বলতে পারো আমার বাস্তবে কল্পনার স্বপ্ন। তোমার তো কোনো সময়-ই নেই, ক্লাস, টিউশন সংগঠন এগুলো নিয়েই ২৪ঘন্টা শেষ! কতবার বলেছি চলোনা একটু দূরে কোথাও ঘুরে আসি।’


জীবনে সব কিছুর জন্যে সময় রাখতে হয় নয়তো পস্তাতে হয়, সবকিছুকে এবং সবাইকেই মানিয়ে নিতে হয় তা-না-হলে জীবন বড় বেদনার।  অনুষদের সব বন্ধুরা মিলে গতবছর গাজীপুরের সাফারি পার্কে গিয়েছিলো তারা। তখনই শিশির আর রিনির প্রথম কোথাও একসাথে ঘুরতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। আর সময় করতে পারেনি শিশির। আর আবদারও মেটানো হয়ে ওঠে না শিশিরের। মধ্যবিত্তের প্রেম বড় কঠিন। আর এই কঠিনের সাথে যে লেগে যায় সে সত্যিকারের প্রেমিকা হয়ে ওঠে।


রিনি মেসেজে লিখেছে, ‘এই জানো, সাফারি পার্কে গতবছর যে উটপাখিটা  দেখে এসেছিলাম, সেটার ডিম ফুটে নাকি দুটি বাচ্চা হয়েছে! পত্রিকা পড়ে জানতে পারলাম। স্বপ্নে দেখলাম তুমি আমাকে নিয়ে সেন্টমার্টিনে ঘুরতে এসেছো। নীলস্রোতের তীর ঘেঁষে সৈকতে তুমি আমাকে সাইকেলে চড়িয়ে ঘুরে দেখাচ্ছো। তুমি আমাকে একটা গান গাইতে বললে। আমি তোমার প্রিয় গানটি গাইতেছিলাম -আগুনের দিন শেষ হবে একদিন, ঝরনার সাথে গান হবে একদিন, এ পৃথিবী ছেড়ে চলো চলে যাই....হঠাৎ করে দেখি আমি সাইকেল থেকে পড়ে গেছি। তুমি বললে- সরি সরি, তোমার গান শুনে আনমনা হয়ে গিয়েছিলাম। তোমার হাতে হাত রেখে হাঁটতে ইচ্ছে করছিল আমার। তোমার হাত ধরতে গিয়ে সাইকেল ফসকে গেছে। সাইকেল চালাচ্ছি সে কথা খেয়াল ছিলনা। হাত ফসকে সাইকেলটা কাত হয়ে গেলো আর তাতেই। সরি। আমি হাসব না রাগবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না, শুধু বললাম ঠিকমত সাইকেলটাও চালাতে পারো না! হটাৎ ছোট ছোট দুইটা বাচ্চা শরীরে ধাক্কা দিয়ে বলছে, আপুমনি দুইটা শামুক নেন। ভাইয়া, আপুমনিকে দুইটা শামুক কিনে দেন। আমার ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। তখন তো আর মনে হয়নি আমি স্বপ্ন দেখছিলাম। স্বপ্ন টা আরেকটু লম্বা হলে এমন কী ক্ষতি হতো?’


শিশির মেসেজটা পড়তে পড়তে মুচকি হাসছিলো। কখন যে আন্টি পাশে এসে দাঁড়িয়ে আছে সেটা তো তার খেয়াল নেই। আন্টি খুব ফ্রেন্ডলি কিন্তু পড়াশোনাতে নো কম্প্রোমাইজ। আন্টি শুধু বললেন, ‘শিশির তোমার ছাত্র কই?’ কী আশ্চর্য! ছাত্র ছাত্রের জায়গায় নেই, মানে চেয়ার থেকে ওঠে পাশের রুমে গেছে। কেমনটা লাগে! মেজাজটা গরম হয়ে গেলো। বদমাইশ কোথাকার, যাওয়ার আগে স্যারকে একটু বলে যাবিনা! পরশ বলে শিশির একটা ডাক দিল। শিশির রেগে দুইটা অংক করিয়ে দিয়ে দ্রুতই চলে আসলো। প্রোগ্রামের সময়ও খুব নিকটে। ময়মনসিংহের বিপিন পার্কে তাদের অনুষ্ঠান। ব্রহ্মপুত্রের তীর ঘেঁষে চমৎকার একটি জায়গা। নদী খাল বিল আকাশ বাতাস পাহাড় পর্বত বরাবরই মানুষকে মুগ্ধ করে।


নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশে সংগঠনের অনুষ্ঠানটি সাবলিলভাবেই সম্পন্ন হলো। কিন্তু শিশিরের মনটা ভালো নেই। কোনো দুসংবাদ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই শিশির হাতে মোবাইলে নিয়ে দেখে একটা মেসেজ এসেছে। পরশদের বাসায় পড়ানোর জন্যে যাওয়া লাগবে না আর। বুঝতেই তো পারছেন কী ঘটেছে? শিশিরের মনটা খুব খারাপ তার ৬ হাজার টাকার সর্বোচ্চ সম্মানির টিউশনটা চলে গেছে! রাস্তার ধার দিয়ে মনমড়া হয়ে শিশির হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতেই গ্রামের বাড়ি থেকে তার বাবার ফোন আসে, ‘বাবা শিশির, কেমন আছিস? তোর মায়ের শরীর টা ভীষণ খারাপ করেছে। ডাক্তার বলেছে আগের ওষুধ গুলো নিয়মিত খাওয়াতে হবে। বাবা, এই মাসে টাকাটা মাস শেষ হওয়ার একটু আগেই যদি দিতি, তাহলে তোর মায়ের ওষুধ গুলো আনতে পারতাম; ২৫ তারিখের মধ্যেই কষ্ট করে টাকাটা দিস, বাবা।’


শিশিরের চোখে পানি। সে কষ্ট চাপা দিয়ে বললো, ‘ঠিক আছে বাবা আমি পাঠাচ্ছি, তুমি মায়ের খেয়াল রেখো।’ রিনিকে নিয়ে সেন্টমার্টিনে সাইকেল চালানোর স্বপ্ন শিশিরদের জন্য নয়। সেটা সারা জীবনের স্বপ্নই থেকে যাবে। শিশিরদের কখনো কখনো স্বপ্ন দেখাও পাপ। শিশিরদের স্বপ্ন ভোরের শিশিরের মতই সূর্য বাড়ার সাথে সাথে হারিয়ে যায়।


এই মুহূর্তে শিশিরের কমপক্ষে ৪ হাজার টাকার প্রয়োজন মায়ের চিকিৎসার জন্য। শিশির ভাবছে রিনিকে জানাবে কী না! রিনির বাবা অনেক বড়লোক। না। রিনিকে বলতে ইচ্ছে করছে না, রিনির কাছে এমনিতেই অনেক ঋণ জমে গেছে। মেয়েটা এতো কেয়ার নেয় অথচ তাকে একটু সময়ও দেয়া হয়ে ওঠে না। শিশির দোলাচালে ভাবছে নতুন আরেকটা টিউশন এনিহাউ ম্যানেজ করতে হবে। কার কাছে টিউশনি চাইবে সে? ভাবতে ভাবতে রাতের খাবারের জন্য হোটেলে আসলো শিশির। হোটেল বয় হৃদয় শিশিরের কাছে এসে বলল,

-ভাই, আজকে সোনালি আর কক রান্না হইছে, আর আছে গরু, হাস, রুই। খাশির গুস্ত চাইলেও দিতে পারমুনা। কোনটা দিতাম ভাই, নাকি বিরিয়ানি খাবেন?

-না কিচ্ছু লাগবেনা, ডাল-ভাত নিয়ে আয়।

-শিশির ভাই, আপনার মনটা কি খারাপ?

-হুম।

হৃদয় আর কথা বাড়ালো না। শিশির খেতে খেতে ভাবছে টিউশনটা কেমন করে দ্রুত ম্যানেজ করা যাবে। বুলবুল ভাইকে একটা ফোন দেই, ভাইয়ের অনেক টিউশন। উনি হয়তো একটা ম্যানেজ করে দিতে পারবেন। না, পাওয়া হলো না টিউশন। প্রয়োজনে চারপাশে কাউকে পাওয়া যায় না। হাতের নাগালের জিনিটাও তখন নয়-ছয় করে, হয়ে ওঠে না পাওয়া, কষ্ট টা আরো যায় বহুগুণে বেড়ে। তবু নিভু নিভু প্রদীপ জ্বলে আশার বাতিঘরে।


দেখতে দেখতে আজ ২৫ তারিখ। মায়ের চিকিৎসার জন্যে শিশিরের টাকা পাঠানোর কথা ছিল। শিশিরের বাবার ফোন আসে,

-তোর মায়ের অবস্থা খুব খারাপ। তুই তো টাকা পাঠাইলিনা বাবা; তুই একবার আইবি বাড়িতে? তোর মা বার বার তোর কথা জিজ্ঞেস করছে।

-আসবো বাবা, আমি টাকাটা পেয়েই আসছি।’

চোখ দিয়ে পানি পড়ছে শিশিরের। শিশিরদের এছাড়া আর কিচ্ছু করার থাকে না। রিনির সাথেও শিশির আর যোগাযোগ রাখছেনা। কিচ্ছু ভেবে পাচ্ছেনা কী করবে, কাল বাসায় কোথা থেকে টাকা ম্যানেজ করে নিয়ে যাবে সে?


আজ ২৭ তারিখ। গতকালকেই ওষুধ নিয়ে বাসায় যাওয়ার কথা ছিল। কোনো ভাবেই টাকা মেনেজ হল না শিশিরের। কী করবে সে? ডিরেক্ট ব্লাড ব্যাংকে চলে গেলো। জীবনে অনেক বার মানুষের উপকারে স্বেচ্ছায় রক্তদান করেছে শিশির। আজ না হয় মায়ের জন্য রক্ত বিক্রি করবে সে! রক্ত বিক্রির টাকায় ওষুধ কিনে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো শিশির। শিশির যখন রাস্তায় বাড়ির পথে তখন রিনি ফোন করেছে,


-শিশির, তুমি কই? আন্টি নাকি অনেক অসুস্থ?

-হ্যা রিনি। শিশিরের কণ্ঠ বুকের জলে ভেজা।

-এই, তুমি কাঁদছো, কাঁদছো কেন? কিচ্ছু হবে না আন্টির।

-রিনি আমি বাড়িতে যাচ্ছি, দোয়া কইরো, এখন রাখি।

-বাড়িতে গিয়েই জানাইও আন্টি কেমন আছে? তুমি তো টিউশনের টাকা পাও নি, টাকা লাগলে জানাইও। 

- আচ্ছা, রিনি।

-তুমি এতো চাপা স্বভাবের কেন? কেনো কিছুই বলো না। আমাকে বলতে তোমার দ্বিধা কিসের?

- বলবো, রিনি। 

-আচ্ছা, আল্লাহ হাফেজ।


গাড়ি থেকে নামতেই স্কুল ফ্রেণ্ড রনির সাথে দেখা।

-শিশির, কেমন আছিস? আন্টির শরীর এখন কেমন?

-বেশি ভালো নারে, যাচ্ছি বাড়িতে।


বাসার কাছাকাছি যেতেই দূর থেকে মানুষের একটা ভিড় চোখে পড়ছে।

যতই কাছে যাচ্ছে মানুষের ভীড় দৃশ্যমান হচ্ছে। বাতাসে একটা করুণ ধ্বনি রো রো করে ছড়িয়ে যাচ্ছে। শিশিরকে দেখেই সবার মুখে ‘ছেলে আইছে, পুত আইছে’ রব শোনা যাচ্ছে। 


সদ্য বিপত্নীক জনাব শফিউর রহমান এক কিনারায় গালে হাত দিয়ে বসে কাঁদতে ছিলেন। ‘ছেলে আইছে’ শুনে দৌঁড়ে উঠে গিয়ে বলতে লাগলেন -শিশির বাবা আইছস?


শিশিরকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন শফিউর রহমান। -বাবা তুই এত দেরি করলি কেন? তুই আসার অপেক্ষায় থেকে থেকে তোর মা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেরে।


শিশির চিৎকার করে কাঁদতে পারলো না। তার চোখ দিয়ে দু' ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো।


লেখক,

সাহিত্যানুরাগী ও স্বেচ্ছাসেবী, সরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা 

সাবেক শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। 


Previous Post Next Post