সকাল ১১টা।
রুমের ফ্যানটাও নষ্ট। ঘুম থেকে ভ্যাপসা গরমে ঘেমেটেমে উঠলো নীল।
উঠে রুমের একমাত্র জানালাটা খোলামাত্র হালকা বাতাস দুলে দুলে প্রবেশ করলো ঘরে। এর মধ্যে একবার ফোনটা অন করে কয়টা মিসকল জমেছে দেখে নিল নীল। আজ ছুটির দিন, মিসকল লিস্টের পুরো জায়গাটা জুড়ে ফোন আসলেও সে ধরবে না।
আয়নায় দাড়িয়ে বগলের গন্ধ পরীক্ষা করলো। নাহ! আরও ১০-১৫ দিন অভাবে নে ভাবে থাকা যাবে। লম্বা ঝাকড়া চুলে হাত বোলাতে বোলাতে খালি গায়ে দিব্যি আবার শুয়ে পুড়ল, সেই বিছানায়। বিছানা বললে ভুল হবে ওটা কোনো এক কালে বিছানা ছিলো, বর্তমানে যুদ্ধ ময়দানে পরিণত হয়েছে।
মিনিট দশেক পর, ঠক! টক! ঠক! ঠক!
চোখ না খুলেই ঘুমের চোখে নীল বললো,
"খোলা আছে!"
একটু উঁকি মেরে সাথে সাথে শাড়ি পরা এক রমনী বাচ্চা কোলে নিয়ে রুমে প্রবেশ
করলো।
রুমে ঢুকেই বললো, "কীরে বলদ!! ১১ বাজে এখনো ঘুমাচ্ছিস? উঠ বলছি, এখনি উঠ।"
নীলের বুকে হঠাৎ একটা কাঁপুনি উঠলো-
কে? কে? অপু?
জী!! সাথে করে আরেকটাকে নিয়ে আসছি।
নীল এক লাফে উঠে বসে হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইলো।
ইতোমধ্যে বাচ্চাটা নীলের কোলে গিয়ে বসে পড়লো আর আপন মনে খেলতে লাগলো, নীলের
কাছে পুরোটাই স্বপ্নের মতো লাগছে যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছে।
অপু বলে উঠলো, "কীরে বলদ! এতোদিন কই ছিলি? তোকে খুঁজে বের করতে কত কষ্ট
হইসে জানোস? তোর মাথায় সব গোবর, বলদ একটা, কী এক অবস্থা করসস নিজের। চুলে আর দাড়িতে
জঙ্গলী মানুষ লাগতেসে। শিল্পীদের কী এটাই ফ্যাশন?"
যাক বাদ দে।
কী অবস্থা করসস রুমের, দেখি দেখি তাড়াতাড়ি উঠ, ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায়
আসোস কী?
নীলকে টেনে তুলে দিয়ে শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুজে পিচ্চিটাকে নীলের কোলে ধরিয়ে
দিয়ে বিছানা গোছাতে শুরু করলো অপু।
নীল পিচ্চিটার দিকে তাকিয়ে রইলো অপলক, সেই চোখ, সেই নাক, ঠিক ছোট বেলার
অপু।
পিচ্চিটা হটাৎ নীলের দিকে তাকিয়ে কান্না করে দিল।
অপু সাথে সাথে আমার দিকে ফিরতেই নাক চেপে ধরলো। ইস! কী অবস্থা তোর। তোর
থেকে তো ডাস্টবিনে এও গন্ধ কম, কয়মাস গোসল করস না? যা এখনই বাথরুমে যা।
এই বলে নীলকে ঠেলে বাথরুমে ঢুকিয়ে দিলো।
নীল বেসিনের আয়নায় তাকিয়ে একটু স্থির হওয়ার চেষ্টা করলো। মনের মধ্যে
একটা প্রশ্নই শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে। যে গল্পটা আজ থেকে ১০ বছর আগে শেষ হয়ে গিয়েছিল
সেই গল্পটাই আবার তার কাছে ফিরে এলো। নিজের অজান্তেই চোখের কোণে জল জমে গেছে। মনে মনে
নিজেকে প্রস্তুত করলো সে। কলটা ছেড়ে মুখ ধুয়ে নিল। বাথরুমের দরজাটা খুলে দেখলো বিছানা
গুছিয়ে অপু তার পিচ্চির সাথে খেলছে,
নীল অপুর সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো, কিছু বলতে পারলো না। অপুর কোলে
মাথা রেখে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলো। যে সে কান্না নয়, একদম হাউমাউ করে বাচ্চাদের
মত কাঁদতে লাগলো। অপুর হয়তো এটার জন্য প্রস্তুত ছিলো। নিজের চোখ মুছতে মুছতে অপু নীলের
মাথায় হাত বোলাতে লাগলো। পাশ থেকে পিচ্চি বলে উঠলো, "আম্মু! আম্মু! ও কাঁদছে কেন?"
অপুর বললো, "পুরোনো একটা পুতুল খুঁজে পেয়েছে এজন্য।"
তখন পিচ্চিটাও এর মাছের মতো করে নীলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, "কেঁদো না
গো সব ঠিক হয়ে যাবে।"
অপু বললো, নীল, "তোর অপু তোর কাছেই থাকবে রে, তোর মধ্যেই বেঁচে থাকবে।"
নীল একটু ধাতস্থ হতেই অপু তাকে বিছানায় তুলে বসালো। আঁচল দিয়ে নীলের
চোখ মুছে দিলো। বিছানার কোণে থাকা পানির বোতলটা নীলকে এগিয়ে দিয়ে বলল, "ধর পানি খা। আর
কাঁদতে হবে না। এইতো আমি তোর পাশে বসে আছি।" নীল বোতলের ছিপি খুলে অল্প পানি খেলো। কিছুক্ষণ
দুজনই চুপচাপ বসে রইলো।
নিজেকে ঠিক করে নীল বললো, "কী খাবি বলতো অপু। আজকে শেফ নীল তার অপুকে রেঁধে
খাওয়াবে। কী? মাস্টার শেফের রান্না ভুলে যাস নাই তো?"
অপু স্বাভাবিক হয়ে নীলের দিকে তাকিয়ে বললো, "কী অবস্থা করসস নিজের ? এই
দিকে আয় বলদ, চল আমার সাথে আগে তোর ঘরের জঞ্জাল সাফ করবো। তারপর তোর গায়েরটা।"
নীল অপরাধীর ভঙ্গিতে মুচকি হেসে অপুকে সাহায্য করতে শুরু করলো। ঘর গুছিয়ে
নীলকে আর পিচিকে নিয়ে বের হলো অপু।
নীল এখানে আশেপাশে নাপিতের দোকান কোথায় আসে চল।
নীল ও বাধ্য ছেলের মত চলতে থাকলো।
বুড়ো নাপিতের দোকানে নীলকে বসিয়ে নাপিতকে বললো, "চাচা ছেলেটা প্রচুর বেয়াদপ হইসে,
চুল দাড়ি একদম ছোট ছোট করে কেটে দিবেন।"
অপু পিচ্চিকে নিয়ে বাইরে অপেক্ষা করতে লাগলো। নাপিত চাচা মুরগি ছাটা চুলের
কাট দিয়ে দিলো তাই নিয়েই নীল হাজির অপুর সামনে।
অপুর সে কী হাসি, হাসতে হাসতে দম যায় অবস্থা।
অপুর শব্দ করা হাসিটা নীলের খুব প্রিয়। অপু হাসতে হাসতে বললো চল বলদ। এবার
তোকে সত্যি সত্যি বলদের মতোই লাগতেসে।
এরপর ওরা একটা সুপার শপে গেল কিছু বাজার করতে।
অপু এসেছে বলে কথা। আজকে নীল মন ভরে
অপুর জন্য রান্না করবে। পুরো সময়টা জুড়ে পিচ্চিটা নীলের কোলে দিব্যি আরামে
ঘুরেছে আর আবদার করেছে।
নীল জানে অপুর চকলেট কত পছন্দ। তাই অপুকে না জানিয়েই বেশি করে চকলেট কিনে নিল নীল। দেখে অপুর সে কী বকা। কিন্তু নীল চুপচাপ শুনছে। অনেকদিন পর কেউ তাকে এভাবে বকছে। নীলের খুবই ভালো লাগছে।
বাসায় পৌঁছে অপু স্টোভে গরম পানি করলো নীলকে বাথরুমে ঢুকিয়ে বললো দাড়া
সাবান আনছি এখন গোসল করিস না।তুই কী গোসল করবি আমার জোনা আসে। সাবান দিয়ে অপু নীলকে
গোসল করাচ্ছে আর নীলের চেহারা দেখে হাসছে। হাসিটা নীলের খুব প্রিয়। অপু বললো, "সাবান
দিয়ে গেলাম আমি। পানি ঢেলে গোসল সেরে আয়। আমি চাল ডাল ভিজিয়ে ডিম সিদ্ধ দিয়ে রাখছি।
তুই বেঁধে খাওয়াবি আজকে।"
নীল মিলিটারি ভঙ্গিতে স্যালুট দিয়ে বললো ওকে বস!!
গোসল করে বের হলে অপু আবার তোয়ালে দিয়ে নীলের মাথা মুছে দিলো। পিচ্চিটা
বলে উঠলো কী মজা। আম্মু আমার মত করে মাথা মুছে দিচ্ছে।
নীল বললো. "এইদিকে আয় পিচ্চি বুড়ি তোকে আজকে খেয়ে ফেলবো।"
আহা দুজনে মিলে সে কী খুনসুটি। অপু তাকিয়ে রইলো দুটির দিকে আর হাসতে লাগলো।
অপু বললো, "তোরা খেলতে থাক আমি বান্নার জোগাড় করি।"
অপু সব জোগাড় করে নীলকে ডাকলো -
কীরে তুই না রান্না করবি? তাড়াতাড়ি আয়।
নীল ছুটে এসে বললো-
হাজির শেহজাদী, হুকুম করুন।
অপু মুচকি হেসে বললো-
জ্বী রান্না করুন।
নীল রান্না ছেড়ে দিয়েছে সে অনেক বছর। কার জন্যই বা করবে খাওয়ানোর লোকটাইতো
ছিল না। গলির মোরের ভাতঘর থেকেই সে খায়। আজ অনেকদিন পর পুরোনো ডেকচি পাতিল গুলো ধুয়ে
মুছে সব তৈরি করে দিলো অপু।
শেফ নীল শুরু করে দিলো তার কারিগরি। নীলের কাছে রান্না একটা শিল্প। শখের
বশেই মায়ের কাছ থেকে সবকিছু শিখেছিল। অপু পুরোটা সময় নীলের বান্না করা দেখে গেল। নিখুত
শেফ এর মতো সব ঠিকটীক ভাবে করছে নীল। অপুর খুব ভালো লাগে নীলকে রান্না করতে দেখতে।
অপু বললো, "মনে আছে নীল? প্রথমবার যেবার তোর কাছে ডিমের কোরমা রান্না শিখছিলাম?
ডিমগুলা এমন ভাজা ভাজসিলাম যে মুরগির ডিমগুলো দেখতে পুরা ডাইনোসরের ফসিল হয়ে গেছিলো। মুখেই
নেওয়া যাচ্ছিলো না। কিন্তু তুই একাই সেদিন সব খেয়ে নিয়েছিলি মজা করে।" বলতে বলতে অপুর
চোখে পানি এসে গেলো।
নীল বললো," মনে থাকবে না আবার? সেদিন
ওগুলো না খেলে তোর কান্না দেখেই পেট ভরাইতে হতো।"
আকাশে মেঘ গড়িয়ে ততক্ষণে ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে। অনমনস্ক হয়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে অপু বললো, "সবকিছু কত সুন্দর হতে পারতো তাই না নীল?"
নীল উত্তর দিলো না। খিচুড়ি বসিয়ে দুজনই জানালার দিকে তাকিয়ে রইলো।
হঠাৎ পিচ্চির কান্নার শব্দ শুনে দুজনই বাস্তবতায় ফিরে এলো।
অপু বললো," নীল, আমি একটু দেখে আসি, আবার কী দুষ্টুমি করছে কে জানে।"
নীল বললো, "হ্যাঁ যা তুই আমি বেগুন ভাজা গুলো করেই আসছি।"
এরপর তিনজনে মিলে বেশ তৃপ্তি করে খিচুড়ি, বেগুনভাজা আর ডিম দিয়ে দুপুরের খাওয়া শেষ করলে।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে খানিক বিশ্রাম নিয়ে অপু বললো, "নীল, চল না ঐ পার্কটাতে।"
নীল বললো-
তোর এখনো মনে আছে?
থাকবে না আবার? একটা হ্যান্ডসাম ছেলের সাথে যাইতাম। আইসক্রিমের আবদারকে
ঠান্ডা লাগবে বলে উড়িয়ে দিয়ে ১০ টাকার বাদাম ধরায় দিতো।
নীল মুচকী হাসলো।
এরপর তিনজন একসাথে বেরিয়ে পড়লো ততক্ষণে বৃষ্টিও থেমে গেছে। পার্কে তিনজন
একসাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নীল এবার আর বাদাম না আইসক্রিমই কিনে দিলো। এরপর দুজন এক জায়গায়
বসে গল্প করতে করতে কখন যে অপু তার মাথাটা নীলের কাঁধে রাখলো আর নীলও অপুর হাতটা ধরে
রইলো কে জানে।দুজনের চোখই ছলছল। পৃথিবীর সর্বসুখ বুঝি এখানেই আছে।
নীল বলল আমাদের জীবনটা এমন হতে পারতো নারে অপু?
অপু কিছু বললো না। নীলকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকলো।
হটাৎ পিচ্চির কান্নার শব্দ শুনতে পেল দুজন। পিছনে ফিরে দেখলো পিচির হাতের
বেলুনটা রাস্তায় পরে আছে। আর পিচ্চি ওটা নিতেই ছুটছে। উল্টো দিক থেকে সজোড়ে একটা ট্রাক
আসছে। দুজনই ছুটলো ছুটতে গিয়ে নীল হোচট খেল একটা পাথরে।
বিকট চিৎকার! উন্মত্ত গতিতে ট্রাকটা চলে গেলো। আর নীল হতভম্ভের মতো তাকিয়ে
রইলো।
নীল! নীল! ওঠ কতগুলো ফোন দিসি তোকে আমিতো ভয়ই পাইসিলাম।
কীরে, উঠ তাড়াতাড়ি।
নীল উঠে বসলো, বালিশের পাশ থেকে ফোনটা হাতে নিল। দেখলো ২০ টা মিসকল।
রাতুল বললো, "আজকে কয় তারিখ মনে আসে?"
নীল বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হলো। আলমারি খুলে হালকা নীল রঙের পাঞ্জাবিটা
পড়ে নিলো।
রাতুল হাক দিলো, "নীল। আমি গাড়ি বের করলাম তুই তাড়াতাড়ি আয়। পথে আবার হৃদিকে
নিতে হবে।"
নীল রেডি হয়ে নিচে দরজায় গিয়ে দাড়ালো, ততক্ষণে লাল রঙের গাড়িটা নিম্নে
রাতুল হাজির। নীল উঠে বসলো, এক যাওয়ার সময় এক জায়গায় গাড়ি দাড় করালো রাতুল।
হাক এলো, "বাবা, আমি এখানে।" হৃদি এক গুচ্ছ সাদা গোলাপ হাতে দাড়িয়ে আছে।
নীল হৃদিকে নিয়ে গাড়িতে বসলো। গাড়ি পার্কের শেষ প্রান্তে পৌঁছালো।
তিনজনই হেঁটে একটা কাঠগোলাপ গাছের নিচে দাড়ালো।
গাছটা বেশ পুরোনো। চারিদিকে কাঠগোলাপ পড়ে আছে। গাছের বাকলে এক জায়গায় খোদাই করে লেখা
"নীল অপরাজিতা"
ঠিক তার নিচে শান
বাঁধানো পাথরে লেখা,
Here lies
Jannatul Haq
Oporajita
1988-2024
-০-
লেখক,
শিক্ষার্থী, আর্কিটেকচার, চুয়েট।