বাবাকে লেখা রুদ্রের চিঠি
আব্বা,
পথে কোন অসুবিধে হয়নি। নাসরিনকে বাসায় পৌছে দিয়ে গত পরশু ঢাকায় ফিরেছি।
আপনাদের মতামত এবং কোন রুপ আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া আমি বিয়ে করে বউ বাড়ি নিয়ে যাওয়াতে আপনারা কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু আমি তো আমার জীবন এভাবেই ভেবেছি।
আপনার সাথে আমার যে ভুল বোঝাবুঝি হলো, তা কখনো চ্যালেঞ্জ বা পিতা-পুত্রের দ্বন্ধ নয়, স্পষ্টতই তা দুটো বিশ্বাসের দ্বন্ধ ।
ব্যক্তি আপনাকে আমি কখনোই ভুল বুঝিনি। আমি জানিনা আমাকে আপনারা কীভাবে বোঝেন! এ তো চরম সত্য যে, একটা জেনারেশনের সাথে পরবর্তী জেনারেশনের অমিল এবং দ্বন্ধ থাকবেই। যেমন আপনার সাথে আপনার আব্বার অমিল ছিল, আপনার সাথে আমার এবং পরবর্তীতে আমার সাথে আমার সন্তানদের। এই দ্বন্দ্ব ও সংঘাত কোন ভাবেই রোধ করা সম্ভব নয়। আমরা শুধু এই সংঘাতকে যুক্তিসংগত করতে পারি। পারি কিছুটা মসৃন করতে। সংঘাত রোধ করতে পারিনা। পারলে ভালো হতো কিনা জানিনা। তবে মানুষের জীবনের বিকাশ থেমে যেত পৃথিবীতে।
আমার মনে পড়েনা এই ছাব্বিশ বছরে একদিনও পিতা হিসেবে আপনার সন্তানদের আদর করে কাছে টেনে নেননি । আশেপাশে অন্য বাবাদের তাদের সন্তানদের জন্য আদর দেখে নিজেকে ভাগ্যহীন মনে হয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে কখনো কষ্ট প্রকাশ করিনি।
ছেলেবেলায় আমার খেলতে ভালো লাগতো, খেললে আমি ভালো খেলোয়ার হতাম; আপনি খেলতে দিতেন না । ভাবতাম, না খেললেই বোধহয় ভালো। ভালো মানুষেরা বোধহয় খেলেনা। আবার প্রশ্ন জাগতো, তাহলে আমার খেলতে ভালো লাগে কেন? আমি কি তবে খারাপ মানুষ?
আজ বুঝি, খেলা, না খেলার মধ্যে মানুষের ভালো-মন্দ নিহিত নয়। কষ্ট লাগে। আমি স্বপ্ন দেখতাম, আমি ডাক্তার হবো। আপনার চেয়ে বড় ডাক্তার হয়ে আপনাকে ও নিজেকে গৌরব দেব। সন্তান বড় হলে পিতারই তো সুখ। আমি সেভাবে তৈরিও হচ্ছিলাম। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধের পর কী যে এক বিরাট পরিবর্তন এলো। একটি দেশ, একটি নতুন দেশের জন্ম হলো। নতুন চিন্তা সব হতে লাগলো। নতুন স্বপ্ন এলো মানূষের মনে, সবাই অন্যরকম ভাবতে শুরু করলো। আমিও আমার আগের স্বপ্নকে ধরে রাখতে পারিনি। তারচেয়ে বড় এক স্বপ্ন, তার চেয়ে তাজা এক স্বপ্ন, তারচেয়ে বেগবান এক স্বপ্নকে আমি কাছে টেনে নিলাম।
আমি সিরিয়াসলি লিখতে শুরু করলাম। আগেও একটু-আধটু লিখতাম। এবার পুরোপুরি। আমি আমার আগের সব চিন্তা-ভাবনার প্রভাব ঝেড়ে ফেলতে লাগলাম। চিন্তা থেকে, জীবন থেকে, বিশ্বাস আদর্শ থেকে অনেককিছুর সঙ্গেই সংঘর্ষ হতে লাগলো। অনেককিছুর সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি শুরু হলো। কখনো ক্ষোভে আমি অপ্রত্যাশিত কিছু করে ফেলতে লাগলাম। আপনার সাথে, আমার সাথে, বিশ্বাসের সাথে মিল এমন মানুষের দেখা পেলাম। তাদের সাথে সংঘাত হলো। একি! সবার সাথে সংঘর্ষ হয় কেন?
মনে মনে আমি ভীষণ অস্থির হয়ে পড়লাম । তাহলে কি এ পথ ভুল পথ? আমি কি ভুল পথে চলেছি? কখনো মনে হয়েছে আমিই ঠিক! এই প্রকৃত পথ! মানুষ যদি নিজেকে ভালোবাসতে পারে, তবে সবচেয়ে সুন্দর হবে। নিজেকে ভালোবাসতে গেলে সে তার পরিবারকে ভালোবাসবে । আর পরিবারকে ভালোবাসা মানেই একটি গ্রামকে ভালোবাসা, একটি গোষ্ঠীর মানুষকে ভালোবাসবে। আর একটি গ্রাম মানেই তো সারা পৃথিবী, পৃথিবীর সব মানুষ। সব মানুষ সুন্দর হয়ে বাঁচবে। পৃথিবীতে কতো বড় বড় কাজ করেছে মানুষ। একটা ছোট্ট পরিবারকে সুন্দর করা যাবেনা? অবশ্যই যাবে। একটু যৌক্তিক হলে, একটু খোলামেলা হলে কতো সমস্যা এমনিতেই মিটে যাবে। সম্পর্ক সহজ হলে কাজও সহজ হয়। আমরা চাইলেই তা করতে পারি। জানিনা এ চিঠিখানায় আপনি ভুল বুঝবেন কিনা!
ঈদের আগে আগে বাড়ি আসব। আম্মাকে বলবেন যেন বড় মামার কাছ থেকে হাজার চারেক টাকা নিয়ে আমাকে পাঠায়। বাসায় রান্নার কিছুই কেনা হয়নি। বাইরের খাওয়ায় খরচ বেশি, এবং অস্বাস্থ্যকর! আম্মার তদারকিতে দেওয়া সম্পত্তির এইটুকুই তো রিটার্ন মাত্র। আপনার সেন্টিমেন্টে লাগতে পারে, লাগাটাই স্বাভাবিক। কারণ, আপনার শ্বশুরবাড়ি। আমাদের কীসের সেন্টিমেন্ট? শিমু মংলায় পড়বে, বাবু স্কুলে; আপনারা না চাইলেও এসব করা হবে । দোয়া করবেন।
শহিদুল্লাহ