জীবানানুভূতির পত্র-১


জীবানানুভূতির পত্র-১

মো. রিদওয়ান আল হাসান

জীবনের গল্প আমার কাছে এক রঙিন নাটক, যেখানে প্রতিটি দৃশ্যই নতুন রহস্য আর প্রশ্ন নিয়ে হাজির হয়। জন্মেছিলাম ময়মনসিংহ শহরে, শহুরে পরিবেশে বড় হওয়ায় গ্রামীণ প্রকৃতির প্রশান্তি ছুঁতে হয়েছে কেবল অভ্যাগত হয়ে। বাবার কর্মসূত্রে এক শহর থেকে অন্য শহরে স্থানান্তরিত হওয়া ছিল শৈশবের অবিচ্ছেদ্য অংশ। শৈশবের প্রথমভাগে ঢাকার বিস্মৃত স্মৃতি, স্কুলজীবনের শুরুতে ময়মনসিংহের স্নিগ্ধতা, আর এর মাঝে সিরাজগঞ্জের নিঃশব্দ তবু নিঃসীম উষাকালীন দিনগুলো একসাথে মিলে আমার শৈশবের বুনিয়াদ গড়ে তুলেছিল। আমি আমার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। তাই, চিন্তার অনির্বচনীয় গ্রন্থি আমাকে তাড়িত করেছে প্রচণ্ড অবসরে, প্রচুর একলা আলাপনে, বাহ্যিক নিরলতার অক্লান্ত বিশ্রামে। তাই, প্রাথমিকভাবে, আমি অন্যদের মতো হতে চাই নি কখনো। আর এখন চাইলেও হতে পারি না।

ক্লাস ফাইভে ময়মনসিংহে স্থায়ী হই। ক্লাস সিক্স থেকে গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলের দিনগুলো ছিল আমার জীবনের প্রথম পরিপূর্ণ অভিজ্ঞতা, সর্বশেষ বীজাধার আর পরিপূর্ণ ফসলের অগ্রীম রোপণ। স্কুল ছিল ব্রহ্মপুত্র নদের ধারে। প্রতিদিন নদের ধারা দেখে মনে হতো- জীবনও তো এই নদীর মতো। কখনো শান্ত, কখনো উত্তাল। প্রতিনিয়ত এগিয়ে যায়, অলক্ষ্যে না, নিয়মের হিসেবে নির্দিষ্ট অভীষ্টে। নদী যেমন অজস্র উপকথার জন্ম দেয়, তেমনি আমার জীবনেও প্রতিটি দিন ছিল এক-একটি নতুন গল্প। সেই গল্পগুলোর অনেক কিছুই হয়তো আমি নিজেই ভুলে গেছি, আবার, অনেক কিছু প্রকাশিত হলেও বেশিরভাগই আমার হৃদয়ের প্রগাঢ় প্রকোষ্ঠের কোণে আশ্রিত। কখনো কখনো উঁকি দিয়ে জানান দেয় যে কিছু গল্প আর স্মৃতির মৃত্যু নাই, আবে হায়াত পেয়ে যায় তারা। বন্ধুত্বের বেমিসাল নিয়ামত, অন্যদিকে, অ্যাকাডেমিক অসুস্থ প্রতিযোগিতার স্বরূপ, আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার অশিষ্ট পরিণতির মেকানিজম কিংবা নর্দমার দুর্গন্ধযুক্ত জলে কীটের বাসা বাঁধার উন্নত প্রক্রিয়ার অত্যন্ত নিকটবর্তী স্বাক্ষী হতে পারার বাধ্যগত সুযোগ পেয়ে জীবনের অনাগত দিনগুলোর আনুপূর্বিক জটিলতা তখনই টের পেয়েছিলাম। অন্যদের মতো না হতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকে সরে এসে- অনেকের মতো অনেক বিষয়ে ডিসেনসিটাইজড হওয়ার চেষ্টা করলেও জীবন নদ আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে দর্শনেন্দ্রিয়ের উঠোনে। থ্যালিস কিংবা সক্রেটিস আমি হতে চাই নি। সেই ভাষা মুখস্ত করার ইচ্ছাও আমার ছিল না, মুখস্ত শক্তির চর্চায় অত্যন্ত অনাগ্রহী আমি বড়জোর ‘এভারেজ’ হতে চেয়েছিলাম- চিন্তার দিক থেকে। কিন্তু, ক্রমাগত হুল ফোঁটানো মৌমাছির মতো অভ্যন্তরীন প্রচুর অবসর আমাকে পার্থক্য করেছে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র থেকে- চিন্তায়। অথচ, আমি এত জটিল মনস্তাত্ত্বিক পরিস্থিতি অনুভব করতে চাই নি। তবুও, জীবনের জ্যামিতি ছোট হওয়ায় তখনও অনেক কিছু অচিন্তিত কিংবা অস্পর্শক থেকে যায়।
ইন্টারমিডিয়েট জীবনের দিনগুলো অনেকটা দৌড়ঝাঁপের ভেতর কেটে যেত। সকাল থেকে সন্ধ্যা—ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, বায়োলজি আর ম্যাথ নিয়ে ব্যস্ততা ছিল ছায়াচিত্রের মতো, আড়ষ্টতা ছিল মস্তিষ্কের ব্যাপক আলোড়নে। বৈজ্ঞানিক সূত্রের ভেতর কবিতার ছন্দ খোঁজা কিংবা ইন্টেগ্রাল ক্যালকুলাসের সমীকরণে জীবনের মানে বোঝার চেষ্টার মতো বালখিল্য তখন প্রিয় বসন্তের মতো শখের বিষয় হয়ে ওঠে। কিন্তু, না পড়া অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান কিংবা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অজানা দিকের নির্মম সম্বোধন আমাকে আরেকটা অভাববোধের দিকে নিয়ে যায়। প্রেমের কবিতা, কথিত-তথাকথিত-অতিকথিত বয়ান কিংবা নাটক-সিনেমা-উপন্যাস যে জীবন না তা ততদিনে বুঝে গিয়েছিলাম। বয়সও তো সমাজের নিয়মে ‘প্রাপ্ত’ হয়েছে ততদিনে। জীবনের এই বাস্তবতা আমাকে তখনই আচ্ছন্ন করে ফেলে। নিউরনের অনুরণনে যুক্ত হয় নিজের নিয়মের গঠনবৈচিত্র্য। পরিবার, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের প্রতি প্রগাঢ় দায়বদ্ধতা তৈরি হলেও আমাকে যে কেউ বুঝবে না তা বুঝে গিয়েছিলাম। কারণ, আমার মুখের শব্দের চেয়ে লেখার শব্দ যতটা না অস্পৃশ্য, তার চেয়েও অস্পৃশ্য আমার প্রাণের শব্দ- চেতনা।
কোনো এক বন্ধুর সঙ্গে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ প্রাঙ্গণে হাঁটতে হাঁটতে উচ্চশিক্ষায় বিভাগ পরিবর্তনের কথা মনে হওয়া আর ভিন্ন ম্যাট্রিক্সের এই অসুস্থ, কৃত্রিম, অমানবিক, নির্জীব সমাজের মিথ্যা- ধ্বংসময়ী বাস্তবতা আমার ভেতরের সেই অস্ফুট প্রজ্ঞা আর দ্বিধার সমন্বয়ে দশার পরিবর্তন ঘটায়। আমি বুঝে যাই, জীবনের গতি বুঝতে হলে হৃদয়ের গভীরে নামতে হবে।
এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ভর্তি হওয়ার পর মনে হয়েছিল, জীবনের নতুন দিগন্ত খুলে যাবে। কিন্তু শহরের কোলাহলে হাঁটতে হাঁটতে টের পেলাম, এই নগরীর আকাশ সীমাহীন হলেও মাটির পথ অনেক সরু। বাঁকের গল্প, মোড়ের গল্প, ডাস্টবিনের গল্প, কুকুরের ঘেউ ঘেউয়ের হেতু কিংবা ছিনতাই হওয়া মূল্যবান রত্নের মালিক যে অসহায় নারী, অথবা যে দম্পতি নবজাতককে শেয়ালের খাদ্য হওয়ার দুর্দান্ত আহ্বান জানায়, তার মত কোটি গল্প তো আমি আমার শহরেই দেখে এসেছি। শূয়র কীভাবে খাবার খায় কিংবা দাঁত গজানোর পরপরই নিজের বাবার পেছনে কামড় দেয় সেই দৃশ্যও তো অজানা ঠেকে না আমার! বেবিলনের রাণী কীভাবে বর্শা হাতে নিতান্ত দুঃখে- অভিমানে পরিণত 'ক্রোধে' সাত আসমানে দাঁড়িয়ে যায় সেই অকৃত্রিম মুহূর্তও আমার চিরচেনাই লাগলো। অন্তর্নিহিত সত্যকে কেবল জোরালো করলো এসব পুনরাবৃত্তি, স্মৃতিকে করলো আলোকিত কিংবা আরও এক ধাপ অন্ধকারাচ্ছন্ন। নতুনভাবে নতুন দিনগুলোর ভয়াবহতার প্রতি অবিরল আস্থা অর্জনে সহায়ক হলো এরকম ঘটনাবলির চমৎকার নিদর্শন। আমাকে করলো আরেকটু আহত, ‘গোলাপের নিচে নিহত’ হয়ে আখিরাতের পথ অতিক্রম করার পর এই ইঞ্জুরি হয়।
আমার বয়সে মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধু জয়, সুকান্ত অমর ‘কবিত্ব’ অর্জন, সিরাজউদ্দৌলা বৃহৎ ‘রাজত্ব’ পেয়ে গেলেও আমার ভাগ্যে আছে বিশ্ববিদ্যালয়/উচ্চশিক্ষা/বহুমাত্রিক দায়বদ্ধতার আড়ম্বরে একজন বাহ্যিক অত্যাধুনিক আর আদতে নিষ্পেষিত ‘শ্রমিক’ হওয়ার বাধ্যতামূলক আয়োজন। আমি তো এর চেয়ে স্বাধীন ‘কৃষক’ আর ‘কবি’ও হতে পারতাম! আমার সেই সম্ভাবনা চাঁদের আলোয় অস্পষ্ট কোনো মানুষের চোখের জলের সুক্ষ্ম কারুকাজের চেয়েও ক্ষীণকায়। তথ্য-প্রযুক্তি কিংবা ম্যাট্রিক্স, কিংবা তথাকথিত পোস্ট মডার্নিজমের সূত্র অনুযায়ী সম্পর্কগুলোও আর আগের মতো স্বতস্ফূর্ত- স্বচ্ছ থাকল না। মানুষের মুখে মুখোশ, অন্তরে অমানবিকতার দাগ, কৃত্রিম মানবিকতার ঢোল পেটানোর অনুষ্ঠানে আমার হৃদয় কত যে নক্ষত্রের পতন অনুভব করেছে, তা, মৃত্যুর পর অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা পাওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত বোঝানো যাবে না। এইবার আমি নিশ্চিত হলাম, বোঝার সহস্র চেষ্টা করলেও কেউ আমার শাশ্বত চেতনাকে ছুঁতেও পারবে না। আমি থাকবো ‘অবুঝ’ কিংবা ‘দুর্বোধ্য’ হয়ে, ভাইস ভার্সা তারা আমার হৃদয়ে। কেননা, আমাকে ধারণ করার শক্তি কারো নেই। মহাশক্তি ‘ভালোবাসা’কে পায়ের নিচে পিষ্ট করে অনাচারের মহা উৎসবে মেতেছে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র। আমাদের মুরব্বিদের প্রজ্ঞায় যে ‘ভালোবাসা’ আঘাত হেনেছে নকল রূপে। আমার নানুর মতো ব্যতিক্রমী বোনই কেবল সেই ঐশ্বরিক আলোকরশ্মিগুচ্ছের মতো 'ভালোবাসা' দিয়ে যায় অগোচরে, জাহেরি মৃত্যুর পরও। আমিও আমার নান্দনিক কাননে শুভ্র আভা ছড়ানো নূরের পূর্ণিমার মতো ‘ভালোবাসা’ দিয়ে একটু শান্তিপূর্ণ উপায়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করব প্রতিনিয়ত। ভিন্ন হওয়ার দায় আমার। যেমন, বিচ্ছিন্নতার দায় বিচ্ছিনতাবাদীর।
মানুষের মধ্যে চিন্তার পার্থক্য, মানবিক সম্পর্কের বিদ্যমান তথাকথিত ‘স্বাভাবিক’ দূরত্ব, উদাসীনতা এবং নৈতিকতার অভাব আমাকে প্রতিনিয়ত ভাবিয়েই যাবে। ক্লুলেস পরিব্রাজক হয়ে আমার ছুঁতে ইচ্ছে হবে মানুষের হৃদয়। তবে, মানুষের হৃদয় ছুঁতে চাওয়াকে ‘অবুঝপনা’ বলে বয়ানও আসবে অফুরন্ত। হয়তো সামাজিক দৃষ্টিতে এটা আমারই ‘বিকৃতি’- চেতনার, উপলব্ধির। আর, আবেগ তো এখানে নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়। বিবৃতি, মিছিল কিংবা স্লোগানে নয়, আমার দিকে মনোযোগী হলে কেউ, আমি নিরাসক্তভাবেই হয়তো তার হৃদয় অনুভব করার অভ্যাস টিকিয়ে রাখবো। এভাবেই, আমার নিতান্ত অপ্রস্তুত অভিব্যক্তি, ভুল-শুদ্ধ, কাজ-অকাজ কিংবা বহু নিয়ন্ত্রিত গঠনতন্ত্রের পরিণামদর্শী স্খলন আমাকে নিজের চিন্তা থেকে মুক্ত করে না। আরও আবদ্ধ করে, একত্র করে, গাঢ় করে আমার অভ্যন্তরীণ সুনির্বদ্ধ বিশ্বাস, আচার, আন্দোলন। আমাকে করে তোলে আরও বেশি একাকী, নির্জন, নিভৃতচারী আর দুর্বোধ্য। যা আমি ভালোবাসতে শুরু করেছি দারুণভাবে।
২৪ জানুয়ারি, ২০২৫ (৩ এএম)
জিগাতলা, ধানমন্ডি, ঢাকা
Previous Post Next Post