সবুজ গম্বুজের নিচে

 


সবুজ গম্বুজের নিচে

—আসাদ চৌধুরী

‘আমার সালাম পৌঁছে দিয়ো নবীজির রওজায়’
না, এ ধ্বনি উচ্চারিত হয়নি একবারও।
যাঁরা হাত নেড়ে বিদায় জানালেন
দীর্ঘ প্রবাসে তারাই হয়ে উঠেছিলেন আপনজন।
'যাত্রা শুভ হোক’
‘ভালোয় ভালোয় দেশে ফিরুন'
এ-সব শুভ কামনার স্নিগ্ধতা
কোলনের বিষণ্ণ-প্লাটফর্মকে নয়
কিন্তু আমাকে স্পর্শ করেছিল।
দু’দুটি বিমান বন্দর পেরোনোর বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়ে।
আমরা এখন জেদ্দায়, সপরিবারে সৈয়দ সাহেবের বাসায়।
ক্যামেরা, অলঙ্কার আরও কি সব টুকিটাকি কেনাকাটা শেষ ।
তারিখ তো আমার জানাই
ছাড়পত্রেই রয়েছে, বলবো না।
আমার নবীকে সালাম জানানাের মতাে
অধিক দরূদ শরীফ কণ্ঠস্থ ছিল না,
চর্চার অভাবে, স্মৃতিশক্তির দুর্বলতার জন্য,
আমি আমার দরিদ্র বাংলা ভাষার বারুদমাখা শব্দ
আর চোখের পানি দিয়ে।
সর্বোচ্চ সম্মান আর মর্যাদার অধিকারীকে সালাম জানাচ্ছি।
অন্তরে অনুভব করার চেষ্টা করছি, কিন্তু পারছি না।
ড্রাইভার বারবার মনে করিয়ে দিলেন,
পুলিশকে বলতে হবে তিনি আমার চাচাতাে ভাই,
এখন অবশ্য আমি তার নাম মনে করতে পারছি না,
আল্লাহ তাঁর হেফাযত করুন,
ফজরের নামায জামাতে না পড়লে
মেয়েদের জন্য হুজুরের রওজা শরীফ বন্ধ হয়ে যাবে।
তিনি স্টিয়ারিং-এ হাত রেখে আমাকে বারবার আশ্বস্ত করলেন।
ধীরে ধীরে দু'পাশের রুক্ষ উদ্ধত পাহাড় উঁকি দিচ্ছে,
ছােট ছােট গাছের আভাস টের পাচ্ছি,
বােধ হয় এ সময় তাহাজ্জুদ নামায পড়া হয়।
মেয়েরা এখন আলাদা, শুধু কোলের ছেলেটা ওর মায়ের সাথে 
স্ত্রী পাশে থাকলে ভাল হতাে,
ওজুর আরবী নিয়ত অন্তত জেনে নিতে পারতাম।
নামায শেষ, ফজরের সংক্ষিপ্ত নামায,
আর আমি এক সময়, রাহমাতুল্লিল আলামিন, আপনার পাশে দাঁড়ালাম।
সমুদ্র একদা আমাকে বিস্মিত করেছিল,
ভােগের এবং ত্যাগের আনন্দও আমার অজানা নয়,
কিন্তু এই মুহূর্তের যে অনুভূতি আমি অক্ষম পদ্যকার,
কেমন করে তার বর্ণনা দেব?
আর আমি সে সময় কতটুকুই বা আমি ছিলাম!
১৯৭১-এ
কুমিল্লার ক্যান্টমেন্টের লাইনে দাঁড়িয়েও আমি এতােটা ভয় পাইনি,
আমার ডর লাগছে, ভীষণ ডর,
যদি বেআদবী প্রকাশ পায় আমার আচরণে, কথায়,
আমার ভুল আরবী উচ্চারণে 
কিম্বা নিয়ন্ত্রণহীন উদ্ধত চিন্তায়
যা পশ্চিমের দ্বারা প্রভাবিত।
করাচীর ছাপা অজিফার যে বই আমি এনেছিলাম
তার কয়েকটা পৃষ্ঠা পুলিশ না কি ছিঁড়ে ফেলেছে,
আমি এক ভারতীয় অথবা শ্রীলংকার বৃদ্ধের মতাে
থামের আড়ালে দাড়িয়ে কিছু পড়ার চেষ্টা করছি ।
আপনি, বলুন, আমার এত কাছে,
অথচ কী বিপুল দূরত্বের ব্যবধান!
ভয়ে কম্পমান আমার দেহ।
আমার দুই পা ভীষণ ভারী হয়ে উঠছে;
অদৃশ্য দুর্বার শক্তি টেনে নিচ্ছে আপনার কাছে,
সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণহীন এই শরীর কি আমার?
ভয়, বিস্ময়, শ্রদ্ধা, ভক্তি, আনন্দ এবং আরও কিছু
যা মানব ভাষায় প্রকাশ করা যায় না,—
যা শুদ্ধ পবিত্রতার মধ্যে, শুচিতার মধ্যে, স্নিগ্ধতার মধ্যেই
জন্ম নিতে পারে—
আমাকে ঘিরে রেখেছিল।
আমি জেনে গেছি, আপনার পাশে কারা কারা শায়িত,
জানি হযরত ওমরকে শােয়ানাের পর
মা আয়েশা মাথার চুল বস্ত্রাবৃত করে এখানে আসতেন, নিজের ঘরে।
কিন্তু আপনার স্বীকৃতি আর সমর্থন না পেলে
কার সাধ্য সবুজ গম্বুজের নীচে ত্রস্ত ছায়া রাখে?
নিজের যােগ্যতা দিয়ে এখানে আসিনি
নিজের যােগ্যতা নিয়েও এখানে আসিনি
তােমার মেহেরবানী, যুক্তিহীন অপার করুণা আছে, তাই,
দন্ড দুয়ের তরে এখানে এসেছে গুণাহগার।
শুধু দন্ড দুই? না, না,
তােমার স্নেহের ছায়া প্রসারিত, সমুন্নত দশ দিকে,
দয়া আর করুণার অফুরান ধারা
থেমে থাকবে সময়ের সামান্য সীমায়? জীবন-মৃত্যুর এপারে ওপারে
জানি, এতােটা বখিল আপনি নন
আপনি তাে দয়ার সাগর।

মুফতি আবদুল্লাহ তামিম, সময় সংবাদ, ২০২৩

Previous Post Next Post