তারাবি


তারাবি

পল্লী কবি জসীম উদ্দীন

তারাবি নামাজ পড়িতে যাইব মোল্লাবাড়িতে আজ,  

 মেনাজদ্দীন, কলিমদ্দীন, আয় তোরা করি সাজ।  

 চালের বাতায় গোঁজা ছিল সেই পুরাতন জুতা জোড়া,  

 ধুলাবালু আর রোদ লেগে তাহা হইয়াছে পাঁচ মোড়া।  

 তাহারি মধ্যে অবাধ্য এই চরণ দুখানি ঠেলে,  

 চল দেখি ভাই খলিলদ্দীন, লুন্ঠন-বাতি জ্বেলে।  

 ঢৈলারে ডাক, লস্কর কোথা, কিনুরে খবর দাও।  

 মোল্লাবাড়িতে একত্র হব মিলি আজ সার গাঁও।   

  

 গইজদ্দীন গরু ছেড়ে দিয়ে খাওয়ায়েছে মোর ধান,  

 ইচ্ছা করিছে থাপপড় মারি, ধরি তার দুটো কান।  

 তবু তার পাশে বসিয়া নামাজ পড়িতে আজিকে হবে,  

 আল্লার ঘরে ছোটোখাটো কথা কেবা মনে রাখে কবে!  

 মৈজদ্দীন মামলায় মোরে করিয়াছে ছারেখার,  

 টুটি টিপে তারে মারিতাম পেলে পথে কভু দেখা তার।  

 আজকে জামাতে নির্ভয়ে সে যে বসিবে আমার পাশে,  

 তাহারো ভালর তরে মোনাজাত করিব যে উচ্ছাসে।  

 মাহে রমজান আসিয়াছে বাঁকা রোজার চাঁদের ন্যায়,  

 কাইজা ফেসাদ সব ভুলে যাব আজি তার মহিমায়।  

 ভুমুরদি কোথা, কাছা ছাল্লাম আম্বিয়া পুঁথি খুলে,  

 মোর রসুলের কাহিনী তাহার কন্ঠে উঠুক দুলে।  

 মেরহাজে সেই চলেছেন নবী, জুমজুমে করি স্নান,  

 অঙ্গে পরেছে জোছনা নিছনি আদমের পিরহান।  

 নুহু আলায়হুছালামের টুপী পরেছেন নবী শিরে,  

 ইবরাহিমের জরির পাগরী রহিয়াছে তাহা ঘিরে।  

 হাতে বাঁধা তার কোরান-তাবিজ জৈতুন হার গলে,  

 শত রবিশশী একত্র হয়ে উঠিয়াছে যেন জ্বলে।  

 বুরহাকে চড়ে চলেছেন নবী কন্ঠে কলেমা পড়ি,  

 দুগ্ধধবল দূর আকাশের ছায়াপথ রেখা ধরি।  

 আদম ছুরাত বামধারে ফেলি চলে নবী দূরপানে,  

 গ্রহ-তারকার লেখারেখাহীন ছায়া মায়া আসমানে।   

  

 তারপর সেই চৌঠা আকাশ, সেইখানে খাড়া হয়ে,  

 মোনাজাত করে আখেরী নবীজী দুহাত উর্ধ্বে লয়ে।  

 এই যে কাহিনী শুনিতে শুনিতে মোল্লা বাড়ির ঘরে,  

 মহিমায় ঘেরা অতীত দিনেরে টানিয়া আনিব ধরে।   

  

 বচন মোল্লা কোথায় আজিকে সরু সুরে পুঁথি পড়ি,  

 মোর রসুলের ওফাত কাহিনী দিক সে বয়ান করি।  

 বিমারের ঘোরে অস্থির নবী, তাঁহার বুকের পরে,  

 আজরাল এসে আসন লভিল জান কবজের তরে।  

 আধ অচেতন হজরত কহে, এসেছ দোস্ত মোর,  

 বুঝিলাম আজ মোর জীবনের নিশি হয়ে গেছে ভোর  

 একটুখানিক তবুও বিমল করিবারে হবে ভাই!  

 এ জীবনে কোন ঋণ যদি থাকে শোধ করে তাহা যাই।   

  

 মাটির ধরায় লুটায় নবীজী, ঘিরিয়া তাহার লাশ,  

 মদিনার লোক থাপড়িয়া বুক করে সবে হাহুতাশ।  

 আব্বাগো বলি, কাঁদে মা ফাতিমা লুটায়ে মাটির পরে,  

 আকাশ ধরনী গলাগলি তার সঙ্গে রোদন করে।  

 এক ক্রন্দন দেখেছি আমরা বেহেস্ত হতে হায়,  

 হাওয়া ও আদম নির্বাসিত যে হয়েছিল ধরাছায়;  

 যিশু-জননীর কাঁদন দেখেছি ভেসে-র পায়া ধরে,  

 ক্রুশ বিদ্ধ সে ক্ষতবিক্ষত বেটার বেদন স্মরে।  

 আরেক কাঁদন দেখেছি আমরা নির্বাসী হাজেরার,  

 জমিনের পরে শেওলা জমেছে অশ্রু ধারায় তার;  

 সবার কাঁদন একত্রে কেউ পারে যদি মিশাবার,  

 ফাতিমা মায়ের কাঁদনের সাথে তুলনা মেলে না তার।   

 আসমান যেন ভাঙ্গিয়া পড়িল তাহার মাথায় হায়,  

 আব্বা বলিতে আদরিয়া কেবা ডাকিয়া লইবে তায়।  

 গলেতে সোনার হারটি দেখিয়া কে বলিবে ডেকে আর,  

 নবীর কনের কন্ঠে মাতাগো এটি নহে শোভাদার।  

 সেই বাপজান জনমের মত গিয়াছে তাহার ছাড়ি।  

 কোন সে সুদূর গহন আঁধার মরণ নদীর পাড়ি।  

 জজিরাতুল সে আরবের রাজা, কিসের অভাব তার,  

 তবু ভুখা আছে চার পাঁচদিন, মুছাফির এলো দ্বার।  

 কি তাহারে দিবে খাইবারে নবী, ফাতেমার দ্বারে এসে;  

 চারিটি খোরমা ধার দিবে মাগো কহে এসে দীন বেশে।  

 সে মাহভিখারী জনমের মত ছাড়িয়া গিয়াছে তায়,  

 আব্বাগো বলি এত ডাক ডাকে উত্তর নাহি হায়।  

 এলাইয়া বেশ লুটাইয়া কেশ মরুর ধূলোর পরে,  

 কাঁদে মা ফাতেমা, কাঁদনে তাহার খোদার আরশ নড়ে।  

 কাঁদনে তাহার ছদন সেখের বয়ান ভিজিয়া যায়,  

 গৈজদ্দীন পিতৃ-বিয়োগ পুন যেন উথলায়!  

 খৈমুদ্দীন মামলায় যারে করে ছিল ছারেখার,  

 সে কাঁদিছে আজ ফাতিমার শোকে গলাটি ধরিয়া তার।  

 মোল্লাবাড়ির দলিজায় আজি সুরা ইয়াসিন পড়ি,  

 কোন দরবেশ সুদূর আরবে এনেছে হেথায় ধরি।  

 হনু তনু ছমু কমুরে আজিকে লাগিছে নূতন হেন,  

 আবুবক্কর ওমর তারেখ ওরাই এসেছে যেন।  

 সকলে আসিয়া জামাতে দাঁড়াল, কন্ঠে কালাম পড়ি,  

 হয়ত নবীজী দাঁড়াল পিছনে ওদেরি কাতার ধরি।  

 ওদের মাথার শত তালী দেওয়া ময়লা টুপীর পরে,  

 দাঁড়াইল খোদা আরশ কুরছি ক্ষনেক ত্যাজ্য করে।   

  

 মোল্লাবাড়িতে তারাবি নামাজ হয় না এখন আর,  

 বুড়ো মোল্লাজি কবে মারা গেছে, সকলই অন্ধকার।  

 ছেলেরা তাহার সুদূর শহরে বড় বড় কাজ করে,  

 বড় বড় কাজে বড় বড় নাম খেতাবে পকেট ভরে।  

 সুদূর গাঁয়ের কি বা ধারে ধার, তারাবি জামাতে হায়,  

 মোমের বাতিটি জ্বলিত, তাহা যে নিবেছে অবহেলায়।  

 বচন মোল্লা যক্ষ্মা রোগেতে যুঝিয়া বছর চার,  

 বিনা ঔষধে চিকিৎসাহীন নিবেছে জীবন তার।  

 গভীর রাত্রে ঝাউবনে নাকি কন্ঠে রাখিয়া হায়,  

 হোসেন শহিদ পুঁথিখানি সে যে সুর করে গেয়ে যায়।  

 ভুমুরদি সেই অনাহারে থেকে লভিল শূলের ব্যথা,  

 চীৎকার করি আছাড়ি পিছাড়ি ঘুরিতে যে যথা তথা।  

 তারপর সেই অসহ্য জ্বালা সহিতে না পেরে হায়,  

 গলে দড়ি দিয়ে পেয়েছে শানি- আম্রগাছের ছায়।  

 কাছা ছাল্লাম পুঁথিখানি আজো রয়েছে রেহেল পরে,  

 ইদুরে তাহার পাতাগুলি হায় কেটেছে আধেক করে।  

 লঙ্কর আজ বৃদ্ধ হয়েছে, চলে লাঠিভর দিয়ে,  

 হনু তনু তারা ঘুমায়েছে গায়ে গোরের কাফন নিয়ে।   

  

 সারা গ্রামখানি থম থম করে স্তব্ধ নিরালা রাতে;  

 বনের পাখিরা আছাড়িয়া কাঁদে উতলা বায়ুর সাথে।  

 কিসে কি হইল, কি পাইয়া হায় কি আমরা হারালাম,  

 তারি আফসোস শিহরি শিহরি কাঁপিতেছে সারা গ্রাম।  

 ঝিঁঝিরা ডাকিছে সহস্র সুরে, এ মূক মাটির ব্যথা,  

 জোনাকী আলোয় ছড়ায়ে চলিছে বন-পথে যথা তথা।  

  

====== 


Previous Post Next Post